বৃষ্টিভেজা দুপুর মানেই বাঙালি হেঁশেল ভুরভুর করত খিচুড়ি আর ইলিশ মাছের সুবাসে। বর্ষার মরশুম মানে ইলিশের তেল, ভাজা, ভাপে, টক আর উপরি প্রাপ্তি হিসেবে ইলিশের ডিম পাতে পড়লে আনন্দে ভরে ওঠে মন। যদিও আজকের মূল্যবৃদ্ধির বাজারে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে ইলিশ দিয়ে ভোজ বিষয়টা অনেকটাই স্বপ্নের মতো। কিন্তু জলের এই রুপোলি শস্যের অমোঘ আকর্ষণকে উপেক্ষা করা বোধহয় বাঙালি রসনা প্রেমীদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলা ক্যালেন্ডার যদিও জানান দিচ্ছে ভাদ্র মাস পড়ে গিয়েছে। তবুও বর্ষা এখনও বিদায় নেয়নি। কখনও নিম্নচাপে ঝরঝর বারিধারা, তো কখনও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি লেগেই রয়েছে।
এহেন ভাদ্রের এক রবিবাসরীয় দুপুরে বাইপাস সংলগ্ন পি. সি. চন্দ্র গার্ডেনের টিউলিপ ব্যাঙ্কোয়েট জমজমাট হয়ে উঠেছিল ইলিশ উৎসবে। ইলিশের গন্ধ যেন ম-ম করছিল হলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জুড়ে। অনুষ্ঠানের আয়োজক স্পাইস অ্যান্ড সসেস। যেটির পুরোভাগে রয়েছেন ছন্দা চক্রবর্তী।
উক্ত প্রতিষ্ঠানটির ২০বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল এই জমজমাট ইলিশ রসনার। প্রসঙ্গত প্রতিবছরই ইলিশ উৎসবের আয়োজন করেন তাঁরা। এবারে তাদের এই উৎসব ১০ম বর্ষে পদার্পণ করল। তবে শুধুমাত্র ইলিশ উৎসবের রসনাতেই নয়, মাছে-ভাতে বাঙালির চিরাচরিত এই উৎসবের সঙ্গে ছিল গান, কবিতাপাঠ ও নৃত্যানুষ্ঠানও। সঙ্গেই ছিল রকমারি স্টলও।
অন্যদিকে অনুষ্ঠিত হয় ইলিশ মাছের রন্ধন প্রতিযোগিতাও। অনেকেই অংশগ্রহণ করেছিলেন এই প্রতিযোগিতায়। তাদের তৈরি বিচিত্র স্বাদের ইলিশ মাছের পদ ছিল এই অনুষ্ঠানের এক অন্যতম আকর্ষণ। সেই প্রতিযোগিদের মধ্যে মৌসুমী হাজরার তৈরি ইলিশের মাখানি, সাথী ঘোষের বাটা ইলিশ, মিতা রায়ের ইন্ডিয়ান সুশি ইলিশ, শঙ্করী দে-র ইলিশের রায়তা, কেকা ভট্টাচার্যর লাউপাতায় ইলিশের ঝোল, মুনমুন ঘোষের কচুপাতায় ভাপা ইলিশের পদ ছিল অন্যতম।
বাঙালি রসনা প্রেমীদের বোধকরি খাওয়ার পাতে ইলিশ থাকলে আর কোনও কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না। সেই কারণেই ইলিশের টানে বহু রসনাপ্রেমীদের পাশাপাশি এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অভিনেতা ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, গায়ক সিধু, সংগীত পরিচালক তথা গায়ক সপ্তক সানাই দাস, চিত্রপরিচালক পাভেল সহ বহু বিশিষ্ট মানুষজন।
এদিনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ গেয়ে মঞ্চ মাতানোর পাশাপাশি সুচারুভাবে দক্ষতার সঙ্গে স্পট ‘কুইজ শো’ সঞ্চালনা করেন সিধু। যদিও সামগ্রিক ভাবে মঞ্চানুষ্ঠানটি সঞ্চালনায় ছিলেন দেবাশিস বসু। এদিনের অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে আয়োজক ছন্দা চক্রবর্তী জানান, “এবারে স্পাইস অ্যান্ড সসেস -এর কুড়ি বছর পূর্তি আর আমাদের ইলিশ উৎসবের দশ বছর। সবমিলিয়ে এর চাইতে ভালো উদযাপন আর কিছুই হতে পারে না। ১০বছর ধরে আমরা ইলিশ উৎসব আয়োজন করে আসছি। শুধু বাঙালিরা নয় গোটা ভারতবর্ষে, এমনকি বিদেশেও ইলিশের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কাঁটার জন্য অনেকেই এই মাছটি খেতে পারেন না। আমরা তাদের বোনলেস ইলিশ খাইয়ে দেখেছি, এর স্বাদ তাদের ভীষণই পছন্দের। এবারেও আমাদের এই অনুষ্ঠানে বিদেশি অভ্যাগতরা এসেছেন। আমরা এবার তাদের ইলিশের বাঙালি পদগুলো পরিবেশন করেছি। তারা খুবই আনন্দ করে, তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছেন।”
এদিনের ইলিশ উৎসবে বিশেষ পদগুলির মধ্যে ছিল ইলিশ ভাজা, মাছের তেল, ইলিশের ডিম ভাজা, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাকের তরকারি, বেগুন দিয়ে, কালোজিরে ফোড়ন দিয়ে ইলিশের ঝোল, ইলিশ ভাপা, ইলিশের টক। ভাস্বরের কথায়, ” এটা খুব ভালো একটা উদ্যোগ। ইলিশ মাছের নানারকম পদ এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। পাশাপাশি এত মানুষ এখানে রন্ধন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন দেখে ভালো লাগছে। আমি নিজেও ইলিশের কয়েকটা পদ টেস্ট করে যাব।”
ইলিশ উৎসব নিয়ে আপ্লুত সিধুর অভিমত, “ছন্দাদির এই সংস্থার পক্ষ থেকে এর আগেও ইলিশ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। সেবার লঞ্চে আয়োজন করা হয়েছিল সীমিত সংখ্যক মানুষজনকে নিয়ে। আমি সেবারেও গিয়েছিলাম। এবার আয়োজনটা অনেক বড় পরিসরে হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশটা দুর্দান্ত। আর ইলিশের প্রতি আমার আলাদা একটা লোভ রয়েছে। কারণ শুধুমাত্র ইলিশ দিয়ে ভোজ.. এটা মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে সব দিন হয় না। আমি মুখিয়ে রয়েছি ইলিশের পদগুলো খাওয়ার জন্য।” সানাইয়ের কথায়, ”আমি খুব একটা খাদ্যরসিক নই। কমই খাই। তবে ইলিশ মাছ ভাজা আর তেল দিয়ে ভাত খেতে ভালোবাসি। আমি ঘটি বাড়ির ছেলে হলেও আমার মামার বাড়ি বরিশালের বাঙাল। তাই আমার জিভের স্বাদটা বাঙালদের মতোই। তবে এখানে গান-বাজনার পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। সিধুদা এসেছেন। খুব ভালো লাগছে।”