বারবার সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে তাঁর নাম। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে নিয়েছেন একের পর এক দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্ত। তাঁর একাধিক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বদলেছে রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থার অবস্থান। গত ১০ মাসে নিয়োগ ও বদলি সংক্রান্ত ১০টি মামলায় তদন্তভার তিনি সটান তুলে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে। তাঁর নির্দেশে চাকরি খুইয়েছেন মন্ত্রী কন্যা থেকে শুরু করে আরও ২৬৯ জন শিক্ষক। আবার তাঁরই নির্দেশে তিন দফায় ১৮৭ জন চাকরিপ্রার্থী দুর্গাপুজোর মুখে শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি পেতে চলেছেন। তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সোমবার সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে একের পর এক হুঁশিয়ারি শানালেন তিনি।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সাফ বলেন, “যারা দুর্নীতি করেছে, ধরা পড়লেই চাকরি যাবে। যারা অসৎভাবে চাকরি পেয়েছে, সবার চাকরি যাবে। তারা কেউ যেন নিশ্চিন্তে না থাকে।” এরপরেই জানান তদন্তের সময় বেঁধে দেওয়ার কারণ। তিনি বলেন, “রাজনীতিবিদরা অত্যন্ত কৌশলী। সময় বেঁধে না দিলে তাঁরা বেরিয়ে যাবেন।”
তিনি মুড়ি-মুড়কির মতো একের পর এক মামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হতে তুলে দিয়েছেন বলে অভিযোগ। এপ্রসঙ্গে
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের যুক্তি, “মুড়ি-মুড়কির মতো দুর্নীতি হয়েছে। তাই মুড়ি-মুড়কির মতো সিবিআই দিয়েছি। নিজেও বেকার ছিলাম, বেকারদের কষ্টটা বুঝি। একই জিনিসের যখন দু’রকম ভার্সন দেখলাম, তখন তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।”
এরপরেই বলেন, “আমায় জুডিশিয়ারি থেকে বহিষ্কার করে দিলেও, আমি মনে করি, যা করেছি ঠিক করেছি। আমি জানি বেকার জীবন কী। রুপোর চামচ মুখে দিয়ে জন্মাইনি। টেরর মাঝেমাঝে অত্যন্ত ভালো ফল দেয়। অফিসারদের মনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে যে, বেনিয়ম করে পার পাওয়া যাবে না।”
কোনও অবস্থাতেই যে দুর্নীতি বরদাস্ত করবেন না, বারবার বলেছেন সে কথা। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “অনেকেই বলেন, সমাজে টিকতে হলে কিছু দুর্নীতির সঙ্গে একটু আপস করতে হয়। কিন্তু আমি এখনও দুর্নীতির সঙ্গে আপস করিনি। ভবিষ্যতেও করব না। অত টাকা আমার দরকার নেই।” শুধু তাই নয়, দুর্নীতির সঙ্গে আপস করবেন না বলেই WBCS-এর চাকরিও ছেড়েছিলেন বলে জানান তিনি।
সাম্প্রতিক অতীতে প্রকাশ্যেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের কড়া সমালোচনা করেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অভিযোগ ছিল, বিচার ব্যবস্থার একাংশের মদতে বিজেপির গুন্ডারা শেল্টার পাচ্ছে। অভিষেকের এই মন্তব্যে বেজায় চটেছিলেন বলেও জানান বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন প্রথম সমালোচনা করেছিলেন তখন আমি লাদাখে ছিলাম। আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, যেহেতু এর সঙ্গে আমারও কিছু কাজ জড়িত তাই আমি একটা রুল ইস্যু করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডাকব। আমি প্রশ্ন করতাম, উনি একথা বলেছেন কি না। আমি আমার মতো করে কাজ করতাম। তাতে আমাকে ভয়ঙ্কর কঠোর কাজ করতে হত। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু যখন কলকাতায় এলাম, দেখলাম ততদিনে ডিভিশন বেঞ্চে একটা মামলা হয়ে গেছে। ডিভিশন বেঞ্চ সেটাকে তত গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। কিন্তু আমার ভিন্ন মত আছে এবিষয়ে। আমি যদি আবার শুনি এভাবে আমাকে নিয়ে কোনও অন্যায় কথা হচ্ছে তাহলে আমি কিন্তু কঠোরতম ব্যবস্থা নেব। তারা যা কল্পনাই করতে পারবে না। যারা এসব কথা বলে তারা কল্পনাই করতে পারে না কত কঠোর ব্যবস্থা আইনের মধ্যে থেকে নেওয়া যায়।”
তবে এদিন মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবহারের প্রশংসা করেছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি রোমন্থন করে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় জানান, নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে নিজেই এগিয়ে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বলেছিলেন, “আপনি আপনার মতো কাজ চালিয়ে যান। আমি আমার মতো কাজ করি।” এই কথা জানিয়েই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “মহিলাকে দেখে অত্যন্ত ভদ্র মনে হয়েছে। হাসিমুখে, ভালো মনে কথাটা বলেছেন মনে হল। কথার মধ্যে কোনও ক্রূড়তা ছিল না।”