তিনি ব্যতিক্রম তো বটেই। প্রায় এক দশক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তারও ঢের দিন মন্ত্রী তথা বিধায়ক কিন্তু বেসরকারি সংস্থায় কর্মরতা তাঁর স্ত্রী অফিস যেতেন পুল কারে। সরকারি কোষাগারের খরচ বাড়িয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হাসপাতালে থাকতে পছন্দ করতেন না। ক্ষমতায় যখন ছিলেন তার সান্ধ্য বিনোদন ছিল মহানগরের সংস্কৃতির অভিজ্ঞান নন্দন। অসম্ভব উন্নাসিক, আংশিক উদ্ধত ভঙ্গিতে ধুতি সামলে সোজা তাকিয়ে ঢুকে যেতেন নন্দনে তাঁর আস্তানায়। আলিমুদ্দিনের কেঠো চেয়ারে বসে গভীর অভিনিবেশ সহ পাঠ করতেন পার্টির দলিল ও পছন্দের বই।
হ্যাঁ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য ছিলেন সাহিত্য অনুরক্ত। আদ্যন্ত মনোযোগী পাঠক। জীবনানন্দ দাশ থেকে পাবলো নেরুদার একনিষ্ঠ পাঠক। সকলেই পারিবারিক সাহিত্য যোগসূত্র নিয়ে আলোচনা করেন কেননা তিনি কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাতুষ্পুত্র ছিলেন। অথচ তার পিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ রচনা করেছিলেন, “পুরোহিত দর্পণ” হিন্দু বাঙালির পুজো পার্বনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। কিন্তু আদ্যন্ত কম্যুনিস্ট বুদ্ধদেব সেই ছোঁয়াচ সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছেন কাফকা, দেরিদা আর নেরুদা। অনুবাদ করেছেন নেরুদার কবিতা। মার্কেজের অনুবাদে তিনি আমাদের পড়িয়েছেন “বিপন্ন জাহাজের এক নাবিকের গল্প”। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের অনুবাদ ‘চিলিতে গোপনে’ যথেষ্ট পাঠক সমাদর পায়। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়ে রচনা “দু:সময়” নাটক ইতিহাসের সাক্ষর হয়ে থাকবে। তবে তাঁর পিছুটান ছিল কবিতা। ভ্লাদিমির মায়াকভস্কির অনুবাদ “এই আমি মায়াকভস্কি” এক অন্য ছন্দের ভাঙ্গা-গড়ার ইতিহাস।
এভাবেই কবিতার হাত ধরেই জীবনযাপন করেছেন তিনি। চিনিয়েছেন বিশ্ব সাহিত্যকে। তাই গদ্যময় জীবনে বিতর্ক তারা করেছে তাঁকে। স্বপ্ন দেখতেন শিল্পায়নের। কিন্তু জমি অধিগ্রহন বিতর্ক সেখানেও তাঁকে পিজু টেনে ধরেছে। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম বিতর্ক সেই স্বপ্নচারণে বাধা হয়ে উঠেছে। ক্রমেই তিনি ও তাঁর সরকার যেন সেই ‘বিপন্ন জাহাজের এক নাবিক’ হয়ে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে নিষ্ক্রমণ করেছেন। এরপরও ব্যতিক্রম তাঁকে এক অন্য মর্যাদা দিয়েছে। গ্লকমায় হারানো দৃষ্টিশক্তি আর সিওপিডি ক্লান্ত ফুসফুস একটু আলো-বাতাসের সন্ধান করে গেছে। বিরল রাজনৈতিক ভাবধারার ব্যক্তিত্বের প্রয়াণ তাই কাঁদাবে তাঁর স্বপ্ন অনুসারিদেরও।