সোমনাথ লাহা
বরাবরই গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে একটু অন্যরকম ভাবনা দর্শকদের সামনে হাজির করে আকাশ ৮। মেয়েদের ব্রতকথায় এবার তারা নিয়ে আসছেন ‘মা শীতলার ব্রত’। শীতলা এমন একজন লোকায়ত দেবী যাঁকে মানুষ ভয়-ভালোবাসা নিয়ে ভক্তি করে। মাঘ মাসের ষষ্ঠ দিনে দেবী শীতলার পুজো করা হয়। শীতলা দেবীর এক হাতে জলের কলস ও অন্য হাতে ঝাড়ু দেখতে পাওয় যায়। ভক্তদের বিশ্বাস কলস থেকে তিনি আরোগ্য সূধা দান করেন এবং ঝাড়ু দ্বারা রোগাক্রান্তদের কষ্ট লাঘব করেন। শীতলার দুই সন্তান —- বসন্ত ও জ্বরাসুর। শীতলার পুজো কীভাবে মর্ত্যে প্রচলিত হলো সেই কাহিনিই উঠে এসেছে এই ধারাবাহিকের হাত ধরে। প্রসঙ্গত, এই প্রথমবার বাংলা টেলিভিশনের পর্দায় মা শীতলাকে নিয়ে কাজ হচ্ছে। ধারাবাহিকটি পরিচালনা করছেন সুমন রায়। দেবী শীতলার আবির্ভাব তথা সৃষ্টি হয় মহাদেবের শ্বেতবিন্দু বা ঘাম থেকে। স্বর্গে একবার ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর যজ্ঞে বসেন। কিন্তু যজ্ঞেভূমে উৎপন্ন অগ্নিশিখা এতখানি তেজদীপ্ত হয়ে ওঠে যে তা থেকে নিরসন পেতে দেবগণ ত্রিদেবকে অনুরোধ জানালে মহাদেবের ঘর্ম থেকে যজ্ঞাগ্নি নিভে গিয়ে সৃষ্টি হয় মা শীতলার। ঘটনাচক্রে ব্রহ্মার অভিশাপে শীতলা শীলা রূপে ও শক্তির আধার রূপে মর্ত্যলোকে গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মর্ত্যের এক নরপিশাচ তার শক্তিবলে বসন্ত ও জ্বরাকে নিজের কাছে আটক করে রাখে। এদিকে ব্রহ্মার বরে যদি কোনও ভক্তিমতী নারী নিজের অজান্তেই শীতলা শীলায় জল-ফুল প্রদান করে তবেই নিজস্বতা পাবে শীতলা। কাহিনি আবর্তিত হয় বনকাপাসি নামক গ্রামের এক চনমনে মেয়ে চরকিকে ঘিরে। বয়স আঠারো ছুঁয়ে ফেলা চরকি থাকে তার খুড়তুতো দাদা গোপাল ও বৌদি রসময়ীর সঙ্গে।তার সর্বক্ষণের সঙ্গী দাদা-বৌদির মেয়ে কদম। রসময়ী চরকির উপর অকথ্য নির্যাতন করা সত্ত্বেও সে কষ্ট পায় না। একদিন গাঁয়ের মোড়লরা বিধান দেয় যে আঠারো বছর বয়স হওয়ার আগে যদি বিয়ে না হয়, তাহলে চরকি সমেত সকলকেই গ্রাম ছাড়া হতে হবে৷ আর যতদিন না বিয়ে হচ্ছে ততদিন গোটা পরিবার জল-অচল হয়ে থাকবে। এদিকে গ্রামের গাঁয়ের প্রান্তে জল আনতে যাওয়া চরকি জল নিয়ে ফেরার পথেই তার জীবনটা বদলে যায় যখন সে নিজের অজান্তেই এক বহু পুরনো ও প্রতিক্ষিত শিলা থেকে মুক্তি দেয় দেবী শীতলকে। শীতলা ধোপানী সেজে বন্ধুত্ব পাতায় চরকির সঙ্গে। চরকি ও শীতলা, দুজনেরই জীবন বিপদ বেষ্টিত। শীতলার প্রয়োজন নিজের শক্তির আধার শীলাকে খুঁজে বের করা এবং একইসঙ্গে তার দুই পুত্রকে মুক্ত করা নরপিশাচের হাত থেকে। অন্যদিকে চরকিকে রক্ষা করা। এদিকে ওই গ্রামেই থাকেন বিত্তশালী পরিবারের গিন্নি গয়না বৌ। আশ্চর্য ক্ষমতা তার। গভীর দৃষ্টিতে কারও দিকে তাকালেই সে পাথর হয়ে যায়। নিজের সৎ ছেলে অপলককে পাগল করে, বয়স বেঁধে শিশুর মতো করে রেখেছে। গয়না বৌয়ের এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ গুরুদেব হলেন প্রচন্ডনাথ৷ বয়স দুইশত হলেও শীতলার দুই সন্তান বসন্ত ও জ্বরা কে যোগবলে বন্দী করে তাদের উপর অত্যাচার করে প্রচন্ডনাথ নিজের বয়সকে কমিয়ে রেখেছে। সে চায় শীতলার সকল শক্তি গ্রাস করে অমর হতে।চরকির জীবনে আসল সংগ্রাম শুরু হয় যখন গয়না বউ চরকির জীবনে শীতলার প্রভাব অনুভব করে চরকিকে তার সঙ্গে সৎ ছেলে অপলকের বিয়ে দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যায়। আসলে তার উদ্দেশ্য চরকিকে কাজে লাগিয়ে শীতলাকে প্রচন্ডনাথের হাতে সঁপে দেওয়া। কীভাবে শীতলার দেবীত্বে উন্নিত হয়ে তার সন্তানদের খুঁজে প্রচন্ডনাথের কবল থেকে মুক্ত করে এবং একইসঙ্গে ভক্তের নিষ্ঠায় দেবীর অস্তিত্ব মর্ত্যধামে প্রতিষ্ঠিত হয় তাই নিয়েই এই ধারাবাহিকের গল্প। ধারাবাহিকে মা শীতলার চরিত্রে রয়েছেন জয়িতা গোস্বামী। চরকির ভূমিকায় দেখা যাবে তিতলি আইচকে। অপলকের চরিত্রে অভিনয় করছেন অর্পন দাস। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন রেশমী ভট্টাচার্য (গয়না বৌ), রূপম বাগ (প্রচন্ডনাথ), অনুভব দত্ত ( অপলকের বাবা অমরেন্দ্র), বিমল গিরি(চরকির দাদা গোপাল), পায়েল ভড় ( রসময়ী), সৃজা( কদম) এবং অন্যান্য শিল্পীরা। ধারাবাহিকটির কাহিনি ও গবেষণাধর্মী কাজটি করেছেন মৌমিতা করগুপ্ত। চিত্রনাট্য লিখেছেন তন্ময় গোস্বামী। সংগীত পরিচালনায় দেবজিৎ। বৃহস্পতিবার জয়েনপুরে ধারাবাহিকের সেটে উপস্থিত ছিলেন পরিচালক সহ অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলীরা। ধারাবাহিকের পরিচালক সুমন রায়ের কথায়, “পুরাণ শাস্ত্রে সেভাবে মা শীতলার উল্লেখ পাওয়া যায় না। সকলেই তাঁকে লোকায়ত দেবী বলেই জানেন। স্কন্দপুরাণ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় লেখা বই থেকে কিছুটা জানা যায়। আমরা পুরাণ ও কল্পনার মেলবন্ধনের মাধ্যমে এই কাহিনিটিকে বেঁধেছি। দেবী শীতলার জার্নি, মর্ত্যে তাঁর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছি এখানে।” জয়িতা জানান, “আমি এর আগে পৌরাণিক চরিত্র করেছি। মা শীতলা চরিত্রটা আপাদমস্তক একটি পজেটিভ চরিত্র। অনেকগুলো ডাইমেনশন রয়েছে। ধীর, স্থিরের পাশাপাশি অনেকগুলো লুকস রয়েছে। তাঁর মধ্যে একটা ধোপানি। সেখানে অন্যরকম গ্রামীণ ভাষা, আবার দেবীর ভাষা শুদ্ধ। দুটোকে মিলিয়ে চরিত্রটা করতে বেশ ভালো লাগছে।” চরিত্রটা ফুটিয়ে তোলার জন্য যথেষ্টই হোমওয়ার্ক করেছেন জয়িতা। তিতলির অভিমত, ” চরকির চরিত্রটা পুরো অন্যরকমের। আমি এতদিন অবধি নরম মনের চরিত্রে অভিনয় করেছি। চরকি সহজ, সোজা। তাঁর উপর অত্যাচার হয়, কিন্তু সে কখনও কষ্ট পায় না।পরিচালক আমায় যথেষ্ট সাহায্য করেছেন চরিত্রটা ফুটিয়ে তোলার জন্য।” অর্পনের কথায়, “আমি এখানে জমিদার বাড়ির বড় ছেলে। সৎ মা তাকে কালো জাদু বলে এমন করে রেখেছে দেখলে মনে হবে বয়স পঞ্চাশ অথচ মনের দিক থেকে সে শিশু। খুব আদরের চরিত্র। যত্ন করে চরিত্রটা তৈরি করা হয়েছে।” পায়েলের মতে, “আমি এখানে চরকির লোভী বৌদি রসময়ীর চরিত্রে অভিনয় করছি। রীতিমতো দজ্জাল এই চরিত্র। আকাশ আটে এটা আমার প্রথম কাজ। ভীষণ ভালো লেগেছে আমার এই চরিত্রটি করতে। চেষ্টা করছি যাতে চরিত্রটা যথাসম্ভব ভালো করে ফুটিয়ে তুলতে পারি।” রেশমীর অভিমত, “গয়না বৌয়ের চরিত্রটি দেখে দর্শকরা ভয় পাবেন। এটা আমার প্রথম পৌরাণিক ধারাবাহিক। পরিচালক আমাকে বলেছেন এই চরিত্রে উনি আমাকে ছাড়া কারও কথা ভাবতে পারেননি। এটা আমার কাছে একটা বড় প্রাপ্তি। এই চরিত্রটির একটি চোখ পাথরের। সে তার গুরুর কাছ থেকে মায়াবিদ্যা শিখে অত্যন্ত শক্তিশালী ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। স্রেফ ছড়া কেটে কাউকে পাথরে পরিণত করতে কিংবা মেরে ফেলতে পারে এই চরিত্রটি। অন্যধরণের চরিত্র। প্রচুর শেডস রয়েছে অভিনয়ের। এই চরিত্রটির শক্তি এতটাই যে মা শীতলার সঙ্গে তার সংঘাতে দেবীকেও সে পিছু হটতে বাধ্য করে। আমার চরিত্রের ইন্ট্রোডাকশন দৃশ্যটিতে একশটা শট নেওয়া হয়েছে। বেশ ভালো লাগছে এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করতে পেরে।”১১জুলাই ‘মা শীতলার ব্রত’ দেখা যাবে আকাশ ৮-এ সোম থেকে শনি প্রতিদিন সন্ধ্যে ৬:৩০টায়।